পৃথিবীতে পাঁচ হাজার বছরেরও বেশি সময়ে যুদ্ধে যে পরিমাণ মানুষ মারা গেছে, তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি মানুষ মারা গেছে মহামারিতে। কেবল মশার কামড়েই এ পর্যন্ত পাঁচ কোটি ২০ লাখেরও বেশি মানুষের জীবন বিপন্ন হয়েছে। যা ইতালির মোট জনসংখ্যার প্রায় সমান। কেবলমাত্র গতবছর বিশ্বে মশার কামড়ে মৃত্যু হয়েছে সাড়ে আট লাখ মানুষের।
একুশ শতকের প্রথম বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবী এখন আক্রান্ত। সংক্রমণের সংখ্যা এরইমধ্যে ২৫ লাখ ছুঁই ছুঁই। এর মধ্যে মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১ লাখ ৭১ হাজার। সংক্রমিত হওয়ার হুমকিতে আছে কমপক্ষে ১০০ কোটি মানুষ। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে খালি হাতের এই অসম লড়াইয়ে মানুষ ক্রমশ দুর্বল হতে শুরু করেছে। যেসব দেশ শিক্ষা-প্রযুক্তি ও জ্ঞানে অনেক এগিয়ে তারাও এখন কাবু। তাই এই যুদ্ধে জয়ী হতে হলে মানুষকে নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে। টিকে থাকতে হলে এই লড়াইয়ে জিততেই হবে মানুষকে!
মানুষ যে এতো দূর পর্যন্ত এসেছে- তা মূলত লড়াই বা টিকে থাকার ইতিহাস। দৃশ্যত মানুষ হয়তো বাঘ-সিংহ কিংবা অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে টিকে আছে। কিন্তু ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়ার মতো অণুজীবের বিরুদ্ধে মানুষের লড়াইয়ের ইতিহাস আরো দীর্ঘ। প্রতিটি লড়াইয়ে জিতেই মানুষ আজ এখানে এসে পৌঁছেছে।
তিনি আরো বলেন, এক সময় সাধারণ জ্বরেও কয়েক মিলিয়ন মানুষ মারা যেত। কলেরার মতো অসুখও মানুষকে বছরের পর বছর ভুগিয়েছে। অথচ এখন এমন রোগগুলোকে মানুষ পাত্তা দেয় না। কারণ এসব রোগ প্রতিরোধের উপায় বের করেছে মানুষ। করোনা হয়তো মানুষকে ভোগাচ্ছে, রোগটি অত্যন্ত ছোঁয়াচে হওয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে, তারপরও শেষ পর্যন্ত মানুষ করোনার বিরুদ্ধেও জয়লাভ করবে। এই ভাইরাসের বিরুদ্ধে মানুষের ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সারা পৃথিবী এখন একসঙ্গে লড়ছে। ভ্যাকসিন (টিকা) উদ্ভাবনের জন্য বিজ্ঞানীরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছেন। এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে একবিংশ শতাব্দীতে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বদলে মানুষ আবার ক্রমশ একত্র হচ্ছে।
সংক্রামক রোগের ইতিহাস থেকে জানা যায়, গুহাবাসী মানুষ যখন পশু শিকার করে জীবন ধারণ করতো তখনই মূলত সংক্রামক রোগের অণুজীবগুলো ছড়াতে শুরু করে। এরপর কৃষিভিত্তিক সমাজে মানুষ গোষ্ঠী ভিত্তিক বসবাস শুরু করলে, এসব রোগ মহামারী আকারে ছড়াতে শুরু করে। ফলে ইতিহাসের বিভিন্ন বাঁকে ম্যালেরিয়া, যক্ষ্মা, কুষ্ঠ, ইনফ্লুয়েঞ্জা, প্লেগ, হাম, গুটি বসন্তসহ অনেক রোগ মহামারির আকার ধারণ করে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মহামারির গতি বেড়েছে। এর কারণ জনসংখ্যার ঘনত্ব ও আধুনিক যোগাযোগ এবং বাণিজ্য ব্যবস্থা। এক সময় কোনো একটি জনপদে মহামারি ছড়িয়ে পড়লে, সেটা অন্য জনপদে ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকত কম। এখন আর সেই অবস্থা নেই। প্রতিটি দেশের সঙ্গে প্রতিটি দেশের যোগাযোগ ও বাণিজ্য রয়েছে। ফলে একের সংক্রামক রোগে অন্যজনও আক্রান্ত হচ্ছে।
তিনি বলেন, পৃথিবী এক ধরনের ভোগবাদী ব্যবস্থায় প্রবেশ করেছিল। অণুজীব নিয়ে গবেষণায় কিংবা স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কমিয়ে দিয়েছিল রাষ্ট্রগুলো। এ কারণেই করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সবাইকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। ভাইরাসটি ১৯৬৪ সালে প্রথম শনাক্ত হয়। এরপর এই শতকে এসে ভাইরাসটির সমগোত্রীয় সার্স কিংবা মার্সের মতো কিছু ভাইরাসও মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। এরপরও ভাইরাসটির প্রতিষেধক না আসায় এখন এটি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর চীনের উহানে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়। এরপর এটি আমেরিকা, ইতালি, স্পেন, জার্মানি, ইরান, ভারতসহ সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে করোনা প্রতিরোধে বেশ কিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ১৬ মার্চ দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। বন্ধ ঘোষণা করা হয় সব কোচিং সেন্টারও। পরবর্তীতে সব সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করা হয়। এরপরও সংক্রমণ কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মহামারি ও রোগবিস্তার-সংক্রান্ত বিদ্যার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নুট ভিটকস্কি বলেন, লকডাউনে করোনাভাইরাসের মহামারির সময় আরো দীর্ঘায়িত হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সিটির রকফেলার বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক আরো বলেন, শ্বাসতন্ত্রের সব রোগই গণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে থামানো যায়। জনগণের ৮০ শতাংশকে এই ভাইরাসের সংস্পর্শে আসতে দিলে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবেই মানুষের দেহে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়। তখন এই ভাইরাসে আক্রান্ত বেশিরভাগ মানুষেরই কিছু হয় না।
নুট ভিটকস্কির এই কথার সত্যতা পেছনের অনেকগুলো মহামারির ইতিহাস থেকেই জানা যায়। ৫৪১ সালের মহামারি জাস্টিনিয়ান প্লেগ অনেকটা এভাবেই রুখে দিয়েছিল মানুষ। সে সময় পুরো ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এই প্লেগ তাণ্ডব চালায়। এর পরবর্তী দুই শতাব্দী ধরেও বিভিন্ন সময়ে রোগটি মহামারি আকার নিয়েছিল। মারা গিয়েছিল প্রায় পাঁচ কোটি মানুষ। যা ছিল তখনকার পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার চার ভাগের এক ভাগ! ইমিউন সিস্টেম শক্তিশালী হয়ে যাওয়ায় কোন ভ্যাকসিন ছাড়াই রোগটির হাত থেকে মানুষ রক্ষা পেয়েছিল।
এরপর ১৩৫০ সালের ব্ল্যাক ডেথ, ১৬৬৫ সালের দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন, ১৮১৭ সালের প্রথম কলেরা মহামারি, ১৮৫৫ সালের তৃতীয় প্লেগ মহামারি, ১৯১৮ সালের প্রাণঘাতী স্প্যানিশ ফ্লুর মতো মহামারিতেও গণ রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টির মাধ্যমে বেঁচে যায় মানুষ।
এসব সূত্র ধরে বলা যায়, এবারও হয়তো করোনার হাত থেকে এভাবে বেঁচে যাওয়া যাবে। আর যদি সেটি নাও হয়, তাহলে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনের পথ এখনো খোলাই রয়েছে। কারণ অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে মানুষকে যে জিততেই হবে!